জয়ন্ত ঘোষাল
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল জাপান সফরে গেছেন। এই খবরটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, কিছুদিন আগেই জাপানের প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে সাপ্রু হাউসে আয়োজিত একটি অর্থনৈতিক সম্মেলনে বলেছিলেন, আর্থিক এবং বাণিজ্যিক দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত—এই দুটি দেশকে সঙ্গে নিয়ে জাপান এখন এগোতে চায়।
শেখ হাসিনা যে প্রথম জাপান সফরে যাচ্ছেন তা তো নয়, এর আগেও তিনি বেশ কয়েকবার জাপান গেছেন। জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটাও নতুন নয়। দুই দেশের সম্পর্কের একটা ঐতিহাসিক ভিত্তিও আছে। এই ঐতিহাসিক সম্পর্কের পাশাপাশি শেখ হাসিনার বর্তমান জাপান সফরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ব্যঞ্জনা আছে, যা ভারতের রাজনৈতিক মহলে তো বটেই, কূটনৈতিক মহলেও এখন জোর আলোচনার বিষয়।
সেদিন সাউথ ব্লকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গে গল্প করছিলাম। তিনি বলছিলেন, ২০১৪ সালে টোকিওতে যখন শিনজো আবে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে একটা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, যেখানে বাংলাদেশকে ৬০০ বিলিয়ন ইয়েন, যা মার্কিন ডলারের হিসাবে সেই সময় ছয় বিলিয়ন ডলার ছিল অর্থমূল্য। তারা একটা ODA -ঋণ বাংলাদেশকে দিয়েছিল। সেই ঋণের শর্ত মেনে বাংলাদেশ যেভাবে অগ্রগতির নমুনা দেখিয়েছে, যেভাবে আর্থিক বিকাশের শতকরা হারকে একটা সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছে, তাতে জাপান অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কেও অনেক বেশি উৎসাহ বোধ করেছে।
সুতরাং প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে পরতে পরতে আরো অনেক বিষয় জড়িয়ে থাকে। কাজেই শেখ হাসিনা যে রকম চীন গেছেন, সে রকম জাপানেও যাচ্ছেন। চীন ও জাপানের সম্পর্ক কী রকম, সেটা আমরা জানি। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সংঘাত এবং নির্ভরশীলতার জটিল সম্পর্ক রয়েছে। আবার চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তানের একটা অক্ষ আছে। সেখানে রাশিয়া ও আমেরিকার যে দ্বৈরথ, তার সঙ্গে সেটা মেলানো যায় না।
এই উপমহাদেশের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশ, তাদের পররাষ্ট্রনীতিতেও অনেক সাযুজ্য আছে। তারা আমেরিকার ন্যাটোর সদস্য হয়নি। তারা রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের সমালোচনা করে। আবার রাশিয়ার সঙ্গেও আর্থিক সম্পর্ক অটুট রাখতে চায়। এখন দেখা যাচ্ছে, জাপান রাশিয়া সম্পর্কে যে নীতি নিয়েছিল, এখন তাতেও বদল নিয়ে এসেছে। জাপান তাদের ঘোষিত যে নীতি, তা যুদ্ধের বিরুদ্ধে হলেও তারা রাশিয়ার কাছে থেকে অনেক দাম দিয়ে তেল কিনছে। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের আর্থিক সম্পর্ককে তারা উন্নতির পথে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এখন শেখ হাসিনা যেভাবে জাপানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী, সেটা তাঁর কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকেই প্রতিষ্ঠা করে।
বাংলাদেশ-ভারত-জাপান : সম্পর্কের রসায়নআসলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে সার্বভৌম শক্তির ওপর দাঁড় করাতে। অর্থাৎ সেখানে থাকবে Autonomy। এই Autonomy শব্দটা এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে। গ্রিক ভাষায় Autos মানে হলো Self, অর্থাৎ নিজের ভেতরের সত্তা। আর ঘড়সড় মানে হলো Rule, অর্থাৎ শাসন বা আইন। সুতরাং ভেতরের Inner self-কে শাসন করা, সেটাই হলো Autonomy । এই স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে বিদেশনীতিতে সার্বভৌম রাস্তা দিয়ে যেতে যে বাংলাদেশ সফল হচ্ছে, সেটারই প্রমাণ হচ্ছে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক। আসলে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেও জাপানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাইছে বাংলাদেশ।
২০২৩ সালে ডিপ্লোমেটিক ব্ল-বুক এসেছে জাপানের। তাদের যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কেননা জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হায়াসি ইয়োসি মাসা বলেছেন, জাপান রাশিয়ার সঙ্গেও কোনো সংঘাতে যেতে চাইছে না। অর্থাৎ গোটা পৃথিবীতে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হোক। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে আমরা এগিয়ে যাই। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমেরিকা ও রাশিয়ার যুদ্ধ এবং চীন-রাশিয়ার একই অক্ষে থেকে আমেরিকার সঙ্গে চীনের যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হোক। সব মিলিয়ে একটা তাণ্ডব নৃত্য শুরু হোক—এমনটা তো কেউ চায় না। কিন্তু এই বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের তাৎপর্যটা কোথায়?
বাংলাদেশের গুরুত্ব যে অসীম, সেটা তখন বোঝা যায় যখন প্রধানমন্ত্রী কিশিদা সাপ্রু হাউসে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স’-এর বৈঠকে পরিষ্কার বলে দেন, বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল আর উত্তর-পূর্ব ভারতের শিল্পোন্নয়নে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে একটা যৌথ অর্থনৈতিক পথনির্দেশিকা তৈরি করা হবে। বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ পলিসিকে সঙ্গে নিয়ে বিমসটেককে গুরুত্ব দিয়ে জাপান যেভাবে এগোতে চাইছে, তাতে এটা খুব পরিষ্কার, চীনের যে সমুদ্রনীতি, সেটা মোকাবেলা করার জন্যও জাপান ভিয়েতনামের মতো কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরি করছে।
বাংলাদেশের আয়তন ক্ষুদ্র হলেও বাংলাদেশের জিওস্ট্র্যাটেজিক যে পজিশন, সেখানে বঙ্গোপসাগরের কাছে বাংলাদেশের যে অবস্থান, সেটা কিন্তু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাঝখানে বঙ্গোপসাগর। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শেখ হাসিনা জাপানের সম্রাটের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। জাপানের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, এই সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এই অঞ্চলের আর্থিক বিকাশে বাংলাদেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। জাপানের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দাই সুকে সিনতানি কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, গোটা জাপান এখন তাকিয়ে রয়েছে শেখ হাসিনার এই সফরের দিকে।
ফিরে আসি নয়াদিল্লির প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরটিকে নিয়ে নয়াদিল্লিতেও এখন আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। একটা সময় ছিল যখন বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গেও বিতর্কে গেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ব্যবধান কেন থাকবে এবং কিভাবে সেটা মেটানো যায়, সেটা নিয়ে আজও শেখ হাসিনার সরকার ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালায়। যেমন—ভারত চীনে গিয়ে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ঘোচানোর জন্য বারবার চাপ দিয়েছে। জাপান ও চীনের সঙ্গেও বাংলাদেশের এই বাণিজ্য ঘাটতি আছে। তবে এই অর্থনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখন বাংলাদেশ সক্রিয়। জাপানের সঙ্গেও এই ঘাটতি কমানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ সক্রিয়। সুতরাং একদিকে যে রকম প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশ আলাপ-আলোচনা করতে চাইছে, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্কটা আরো মজবুত করার জন্য শেখ হাসিনা বেশ কিছু দ্বিপক্ষীয় কর্মসূচি গ্রহণ করবেন।
আসলে বিশ্বরাজনীতি একটা জায়গায় থেমে থাকে না। বিশ্ব কূটনীতিও কোনো স্থিতিশীল ধারণা নয়। জাপানে গিয়ে হিরোশিমা-নাগাসাকির ভয়ংকর স্মৃতিবাহী প্রবীণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। দেখেছি, সেই সব বিধ্বস্ত প্রান্তর আবার কিভাবে নব কলেবরে নতুন উন্নয়নের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের জাপান যাত্রীর চিঠি দেখেও বোঝা যায়, তিনি কিভাবে জাতটাকে বুঝেছিলেন, বিশ্লেষণ করেছিলেন।
হিরোশিমা-নাগাসাকি আক্রমণ করেছে যে দেশ, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও আজ জাপানের সম্পর্ক কত মধুর। অতীতের সেই ভয়াবহ স্মৃতি মুছে জাপান সামনের দিকে চলছে। এখন কূটনীতিতে একটা টার্ম ব্যবহৃত হয় ‘ডিপ্লোমেসি অব অ্যাপোলজি’। অতীতের বহু ঘটনার জন্য বর্তমান শাসক ক্ষমা চেয়ে এই বিশ্বায়নের দিনে বিশ্ববাণিজ্যের জন্য আবার একে অন্যের বন্ধু হয়ে ওঠে। ব্রিটেনের রানি পর্যন্ত ভারতের পাঞ্জাব শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগে এসে ক্ষমা চেয়ে গেছেন।
এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপন করেছে এবং জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপন করেছে। জাপান একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেও, ন্যাটোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেও রাশিয়াকে সম্পূর্ণ শত্রু করতে আর চায় না। জাপানে গিয়ে দেখেছি, আগে তাদের প্রতিরক্ষা খাতে খরচের বাজেট ছিল শূন্য, এখন তা নয়। এখন শুধু নৌবহর নয়, বিভিন্ন দিক থেকে জাপান প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও এগোচ্ছে, ব্যবসা করছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও জাপান প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে। ফলে সময়ের হাত ধরে বদলাতেও হবে, আবার সার্বভৌম রাষ্ট্রের মৌল দর্শন, যেটাকে আমি বলেছি Autonomy, সেটাকেও রক্ষা করতে হবে।
লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি