বরিশালের মহিউদ্দীন আহমেদ শেষ পর্যন্ত সমগ্র বাংলার গণমানুষের মহিউদ্দীন আহমেদ হ’য়ে
উঠেছিলেন। গণমানুষের শোষণমুক্তির সংগ্রামে তিনি ছিলেন সর্বসমন্বয়ক সংগঠক, সর্বত্যাগী কর্মযোগী।
মহিউদ্দীন কৈশোরকাল থেকে আমৃত্যু সাধারণ মানুষের অবস্থান উন্নয়নে যুদ্ধ করেছেন এবং এই যুদ্ধ ছিল
তুলনাবিহীন। গণআন্দোলনের গভীরতা গণমানুষের কাছে তিনি তুলে ধরতে পেরেছিলেন। সমাজতন্ত্রের
ধ্যান-ধারণায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মহিউদ্দীন আহমেদ অতি-সাধারণ মনের কোনো রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না,
তিনি কখনো সস্তা-জনপ্রিয়তা প্রত্যাশী সংগঠক ছিলেন না। সারা জীবন তিনি গুরুতর চিন্তাভাবনার মাধ্যমে
,গভীর জীবনবোধে ঔদ্ধুদ্ব হয়ে প্রতিটি অনাচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক,রাষ্ট্রিক
আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে চুড়ান্ত সাফল্য অর্জন অবধি জেল-জুলুম , মামলা হামলা
সবকিছু সহ্য করে গেছেন। পুরো প্রক্রিয়াটা চলেছে আপোষহীন পন্থায়। বিশ^মানবতার মুক্তিসংগ্রামের
ইতিহাস ও বিশ্লেষন সমূহ তিনি অধ্যয়ন করেছেন ব্যাপকভাবে মেধাবী শিক্ষার্থীর কায়দায়। তিরিশের দশক
থেকে ১৯৯০ দশক অবধি পুরো ছয় দশক মহিউদ্দীন আহমেদের গন আন্দোলনের যে ভ‚মিকা তা
একেবারেই পৃথক দুরুহ একটি কাজ। তাঁকে সবসময়ই বিরামহীন থাকতে হয়েছে । আর এই থাকাটাই
ছিল তাঁর চরিত্রের প্রকৃত ভিত্তি।
রাজনীতিক মহিউদ্দীন আহমেদের নিজ জীবন দর্শনছিল অত্যন্ত উচু স্তরের। তাঁর বাবা আজহার উদ্দীন
আহমেদ ছিলেন ১৯২০ ও ১৯২৩ সালের বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য। এখনকার ছয়টি উপজেলার সমান
এলাকা ছিল একেকটি সংসদীয় এলাকা । আজহারউদ্দীন সাহেবের বড় ছেলে শিবপুর ইঞ্জিনিয়রিং কলেজে
লেখাপড়া করে গ্রজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলেন । পরবর্তীতে তিনি সরকারের প্রধান প্রকৌশলী হয়েছিলেন
। আজহারউদ্দীন সাহেবের দ্বিতীয় পুত্র প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ প্রফেসর এম ইউ আহমেদ যিনি বিভিন্ন সরকারী
কলেজে অধ্যাপনা শেষে ,শেষাবধি ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে অবসরে যান । প্রফেসর ্এম ইউ
আহমদ ভারত উপমহাদেশের একজন মনোরোগ চিকিৎসক হিসেবে ও একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ত¡ ।
পারিবারিক কারণে মহিউদ্দীন আহমেদ যে বিশাল পরিবেশ পেয়েছিলেন সেটা রাজনৈতিক ও মানব সেবার
ব্রতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল । যে কারণে মানবতা এবং দেশপ্রেমে মহিউদ্দীন আহমেদের অবস্থান ছিল
অটল।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহ্উিদ্দীন আহমেদ প্রায় সমবয়সী। রাজনীতিতে দ্ইুজনই
সমসাময়িক। আদর্শগত ভাবেও তাঁরা ্উভয়ই কাছাকাছি অবস্থানে ছিলেন । কৈশোরে ও তারূণ্যে এক্ই
মুসলিম ছাত্রলীগ করেছেন । কলেজ জীবন ্উত্তীর্ণ হবার পর দু’জনই ‘ বিট্রিশ খেদাও’ আন্দোলন থেকে
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অবধি এমন কী তারপরেও ১৯৪৯ সালের ২৩ জন অবধি তাঁরা উভয়েই মুসলিম
লীগ করেছেন। তার পরে কিছুকাল তাঁরা পৃথক অবস্থানে ছিলেন , কিন্তু আদর্শগত ভাবে উভয়্ইে পাকিস্তান
মুসলিম লীগের ‘কুচক্রী’ অংশের বিরোধী ছিলেন। ১৯৫২ সালের কারাবন্দী দশায় তরূণ নেতা আওয়ামী
মসিলিম লীগ যুগ্নসম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুসলিম লীগ পরিত্যাগকারী তরুণ নেতা মহিউদ্দীন
আহমেদ অন্যতম রাষ্টভাষা বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার দাবীতে এং মুসলিম লীগ সরকারের অনাচারের বিরূদ্ধে
ও অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে কারাগারে অনশন শুরু করেন। তখন তাঁদের দুজনকেই ঢাকা কেন্দ্রীয়
কারাগার থেকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। স্বৈরতন্ত্রী মুসলিম লীগ সরকারের ক্ষমতারÑভিত
নড়বড়ে করে দিলÑ শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দীন আহম্মেদের যৌথÑঅনশন ধর্মঘট। একদিকে
কারাাগারের বাইরে ভাষা আন্দোলনের তুমুল উওাপ সমগ্র পাকিস্তান কাঁপানো রাজপথ, আর তার পাশাপাশি কারাগারে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দীন আহম্মেদ আমরণ অনশন ধর্মঘট দুইÑআন্দোলন মিলে মিশে ষড়যন্ত্র
নির্ভর সরকারের দাঁত ভাঙ্গার জবাব দিল।
১৯৩০ দশকের শুরুতেই স্কুল শিক্ষার জীবন-কাল আরম্ভ; সেই থেকে তাঁর ব্রিটিশ রাজত্ব্যের উপনিবেশবাদী
দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ সংগ্রামের লড়াকু-জীবনের শুরু, তারপরে প্রায় একটানা ছয় দশক ধরে চলছে
তাঁর অক্লান্ত শ্রান্তিহীন সংগ্রামমুখর জীবন। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসন- শোষন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে যে
স্বাধীনতার সংগ্রাম, মহিউদ্দীন আহমদের কৈশোর আর তরুনের সেই রাজপথÑকাঁপানো লড়াই ছিল একটা
অনন্য সাধারণ ঘটনা। বরিশালের দক্ষিনাঞ্চলের গ্রামীন পরিবেশে বেড়ে-ওঠা সাদামাঠা মানবিক জীবনের
কিশোর তার তারুণ্যের –পানে বেড়ে –চলা জীবনের পথে সে পেয়ে গেল বাঙলার তথা ভারতবর্ষের নিপিড়িত-
মানুষের ”ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসক খেদাও” আন্দোলনের মহামিছিল । তিনি সেই মিছিলের অগ্রভাগের
সংগঠক হলেন, নিজের প্রাণ বিসর্জন সংগ্রামের একটি অপরিহার্য- পথ খুজে নিলেন। অবিভক্ত-বাংলার
নদীয়া এলাকায়, কলকাতা মহানগরীতে, সেই সাথে বরিশাল জেলা শহর এলাকায় এবং একই সাথে
বরিশালের দক্ষিণঞ্ঝলের পিরোজপুর ,মঠবাড়ি, ভান্ডারিয়া, পাথর ঘাট, বামন, বরগুনা ,পটুয়াখালী এই
অঞ্চলে তিনি ‘ ব্রিটিশ খেদাও ’ সংগ্রামে বড় সংগঠক হলেন ।’ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলনে তরুণ মহিউদ্দীনের
মিছিলে-সভা সমাবেশে দৃপÍ পদচারনা ছিল জীবনের উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। সেই সময় তাঁর নেতা ছিলেন
শের- ই-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, হাশেম আলী খান এবং আরো উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। স্কুলও
কলেজ জীবনে নদীয়া ও বরিশালে, কলকাতায় ,রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সমগ্র ভারত উপমহাদেশে চষে
বেড়িয়িছেন মহিউদ্দীন আহমেদ। ১৯৪০ সালে মাত্র ১৮বছর বয়সেই তিনি বড় –সংগঠক হয়ে উঠেছিলেন।
ণীড়িত ভারতীয় জনতার মুক্তি সংগ্রামের অগ্রসেনা গোষ্ঠীর এই গণনায়ক।
মহাত্মা গান্ধী ভারতের জাতির পিতার অবস্থানে গেলেও মূল সংগ্রামের প্রকৃত নেতা হয়ে ওঠেন নেতাজী
সুভাষ চন্দ্র বসু। তাঁর অতুলনীয় দেশপ্রেম, অপরিমেয় সাহস, বিশ^মানের জননেতার সব গুণাবলী ধারণ
করে এক অসামান্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। মহিউদ্দীন আহমেদ সেই তিরিশ চল্লিশের দশকে নেতাজি
সুভাষ বসুর একনিষ্ঠ অনুসারী। বিপ্লবী সুভাষ বসুর কথায়- আদর্শে তিনি তখন প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।
সেই স্বাধীনতার যুদ্ধ চলতে চলতে যখন ভারতবর্ষের জনগন চরমভাবে নির্যাতিত তখন ব্রিটিশরা উপমহাদেশ
ছেড়ে যাবার সময় দেশকে ভাগ করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ধ্বংস করে দিয়ে গেল। সেই সময়
“পাকিস্তান” নামক নয়া-উপনিবেশবাদী নয়া-শোষক রাষ্ট্রের যাঁতাকলে পড়লো বাঙালি জাতি। এইবার
পাকিস্তানী উপনিবেশবাদী দুর্গের বন্দীদশা থেকে মুক্তির লড়াই এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার
সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় বিশাল যুদ্ধ- যদ্ধের শেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পরে নতুন জাতির সামগ্রিক
পুণর্গঠনে নেতৃত্বদেবার এক অবিরাম লড়াই, দেশি- বিদেশী গণশত্রæদের নির্মূলের সংগ্রাম, নিজস্ব শক্তিতে
জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে প্রচÐ শক্তিময়তার ভিতের ওপর দাঁড় করানোর কাজে মহিউদ্দীন আহমেদ
অবিচলিতভাবে এগিয়ে এলেন।
মহিউদ্দীন আহমেদ তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের বিশাল সময়কার যে পটভূমি প্রত্যক্ষভাবে
পূর্ণ করতে পেরেছেন-তাঁর নেপথ্যে তাঁরই পিতার অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ । মহিউদ্দীন আহমেদকে তাঁর
পিতা পান্না নামেও ডাকতেন । মহিউদ্দীন আহমেদ ১৯২২ সালে বৃহত্তর বরিশাল জেলার পিরোজপুর
জন্মগ্রহণ করেছিলেন । তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সমকালীন এবং ঘনিষ্ঠতম রাজনীতিবিদ। বাঙ্গালীর
শাসনশোষণের বিরুদ্ধে অটল এক সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব । স্বৈরাচারের বাহিনী তাঁর ওপরে অসংখ্যবার হামলা
চালিয়েছে , তাঁর শরীর রক্তাক্ত হয়েছে । বার বার কারাবন্দী হয়েছেন, প্রাণ হারানোর ঝুঁকি নিয়ে কারাগারে
অনশন করেছেন- কিন্তু কাপুরুষের মতো নত হননি। গণমানুষের মুক্তির সংগ্রামে তাঁর দৃঢ় মনোবল এক
অফুরন্ত অঙ্গীকারে উদ্দীপ্ত ছিল। মহিউদ্দীন আহমেদের পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিল তীব্র । জিন্নাহকে দেখে তিনি
বর্ণনা দিয়েছিলেন , জিন্নাহর চোখ দুটি ছিল তীক্ষœধার, ভয়ঙ্কর ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির ।
এবং আইয়ুব খাঁর দোসর মোনেম খাঁর বর্ণনা দিয়েছেন, ‘মোনেম খাঁর চোখ ছিল ভাবলেশহীন, কেউ সে
চোখের ভাষা সহজে পড়তে পারতো না।
মহিউদ্দীন আহমেদ ১৯৩৬ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেন। ১৯৪০ সালে মুসলিম
লীগ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত রাজনীতিতে ঘটেছিল তাঁর ঝটিকা উত্তরণ।
১৯৪৩ সালে তিনি সর্বভারতীয় ছাত্রনেতার দুর্লভ মর্যাদা পেয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ছিলেন বরিশাল
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৪৬ সালে হয়েছিলেন বরিশাল জেলা মুসলিম লীগের সাধারণ
সম্পাদক। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গেঁ, তখন তিনি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন
ফরিদপুর জেলে আটক। দু’জনেই তখর কারাগারে অনশনরত ছিলেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বচনে
যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে প্রচুর ভোটে নির্বচিত হন । ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৬
সালের ৬ দফা আন্দোলন এবং ৬৯-এর গণ আন্দোলনে মহিউদ্দীন আহমদ ছিলেন প্রথম সারির নেতা।
১৯৭১ সালের যে যৌথ নেতৃত¦ স¦াধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করে, তিনি ছিলেন তারই একজন , ১৯৭৩ সালে
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নিবাচিত হন। এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেনের দ্বায়িত¦
পালন করেন। ১৯৭৩ সালে বাকশালের পলিটব্যুরোর সদ্যস হিসেবে মনোনিত হন । বঙ্গবন্ধুর নির্মম
হত্যাকান্ডের পর ১৯৭৯ সালের ভারপ্রাপ্ত সভাপ্রতি হিসেবে আবার আওয়ামী লীগ পুনগঠিত করেন। ১৯৭৯
সালে বিরোধী দলের উপনেতার দায়িত্ব পান এবং একই সঙ্গে জেনারেল জিয়ার বিরোধী আন্দোলনে প্রচন্ড
শক্তি সঞ্চার করেন। অনুরুপ জেনারেল এরশাদের নিবাচন বজন করে তার পতনকে ত্বরান্বিত করেন ।
মহিউদ্দীন আহমদের জীবন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূণ একটি বিশস্ব বিবরণ । মহিউদ্দীন
আহমদের সহধমিণী রেবেকা মহিউদ্দীন প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন , সারাজীবন তিনি মেহনতী মানুষের স্বাথে
রাজনীতি করেছেন। নিজের কিংবা পরিবার নিয়ে ভাববার সময়ই ছিলনা। প্রকৃতপক্ েবিদ্রোহ বাঙালী
জাতির সহ্রস বছরের সংগ্রামে মহিউদ্দীন আহমেদ বাঙালী জাতির অস্বিতের সঙ্গে প্রবহমান থাকবেন।
আমাদের চেতনায় তিনি চিরকাল দীপিÍ ছড়াবেন।
লেখক ঃ সম্পাদক ওয়াসিংটন নিউজ২৪